বলো, সূখ কোথা পাই | বেলা ফুরাবার আগে | আরিফ আজাদ

 



সুখ কী?—এই প্রশ্নটা মানুষের সুপ্রাচীনকালের। সুখের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে কতশত রকমের তথ্য আর তত্ত্ব মানুষ যুগে যুগে দাঁড় করিয়েছে তার কোনাে ইয়ত্তা নেই। সুখকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য মানুষ কখনাে আশ্রয় নিয়েছে দর্শনের, কখনাে বিজ্ঞানের। কখনাে সে বস্তুবাদের চাকচিক্যময় বিলাসিতাকেই মনে করেছে সুখের অন্তর্নিহিত রহস্য। আবার কেউ কেউ একান্ত স্রষ্টার মাঝে নিজেকে সঁপে দেওয়ার মধ্যেই খুঁজে নিয়েছে নিজের সুখ। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, সুখ আসলে কী?


আধুনিক বিজ্ঞান যখন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, রহস্যাবৃত জিনিসগুলাে যখন মানুষ জেনে নিচ্ছে একের পর এক, যখন শহরগুলাে ভরে উঠছে ইট-পাথরের ইমারতে, যখন বন-জঙ্গল উধাও হয়ে কল-কারখানায় ছেয়ে যাচ্ছে বিরান ভূমি, তখন একদল লােক এসে আমাদের জানাল—সুখ আসলে ভােগে। এই দুনিয়াকে উপভােগ করার মধ্যেই আছে সুখ। যার বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, যশ-খ্যাতি আছে, আছে আমােদ-ফুর্তির জন্য বর্ণাঢ্য সকল আয়ােজনের সামথ্য—জগতে সে-ই হলাে সুখী। তারা হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতাে আমাদের এমন পার্থিব সুখের দিকে আহ্বান করতে লাগল। তাদের বাঁশির মধুর সুরে দুলে উঠল আমাদের মন। তারা আমাদের বােঝাতে সক্ষম হলাে যে, এই জীবনটাই শেষ। মৃত্যুই সবকিছুর সমাপ্তি। এরপর আর কিছু নেই, কিছু না। কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। সুতরাং, এই জীবনকে যে যত বেশি উপভােগ করতে পারবে, সে তত বেশি সুখী মানুষ।
আমরা শুনলাম। এরপর সুখী মানুষ হবার জন্য নেমে পড়লাম একটা দুরন্ত প্রতিযােগিতায়। এই প্রতিযােগিতা বড় হবার প্রতিযােগিতা। কাকে ছাড়িয়ে কে বড় হৰ। কাকে ছাপিয়ে কে এগিয়ে যাব। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নির্ধারিত হলাে। কাড়ি কাড়ি টাকায় আমাদের ব্যাংক ভরতি থাকতে হবে। আমার নিজস্ব গাড়ি থাকতে হবে, বাড়ি থাকতে হবে। আমাকে জৈবিক সুখ দেওয়ার জন্য একদল সুন্দরী রমণী থাকতে হবে। যশ-খ্যাতি তাে অবশ্যই থাকা চাই। মিডিয়াতে আমি হব ‘টক অব দ্য টাউন, পত্রিকার টক অব দ্য ডে'। আমাকে নিয়ে ফিচার হবে, প্রদর্শনী হবে। আমাকে একনজর দেখার জন্য, আমার একটা অটোগ্রাফের জন্য মানুষ দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকবে, তবেই-না আমি সুখী মানুষ!

কর্পোরেট দুনিয়ায় খ্যাতিই সবকিছু। যার খ্যাতি নেই, সে সুখী নয়। সুখী হতে হলে তাকে খ্যাতি অর্জন করতে হবে। কিছুদিন আগে একটা গুঞ্জন চাউর হয়েছিল জোরেশােরেই। হলিউডের এক অভিনেত্রী তার যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়। অভিনয় জগতে খ্যাতির জন্য তাকে পর্দার পেছনের এবং সামনের পুরুষদের বিছানায় সঙ্গ দিতে হয়েছে। হতে হয়েছে অনেকগুলাে পুরুষের উপভােগের বস্তু। খ্যাতির তাড়না আর মােহে অন্ধ এই অভিনেত্রী হ্যামিলনের সেই বংশীবাদকদের সুরে নিজেকে একাত্ম করে রেখেছিল। ভেবেছিল, এতেই বুঝি সুখ। এতেই বুঝি জীবনের সকল প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তি আর সুখলাভের আশায় বিলিয়েছে নিজের সর্বস্ব। হয়েছে পুরুষদের বিছানার সামগ্রী। যখন তার হুঁশ ফিরল, যখন বুঝতে পারল যে, এটা আসলে সুখ নয়, মরীচিকা—তখন সে সােচ্চার হলাে, প্রতিবাদ জানাল। টুইটারে লিখল If you've been sexually harassed or assaulted, write 'me too' as a reply to this tweet'. 6211 গেল, এই টুইটের প্রতিউত্তরে হাজার হাজার টুইট আসতে লাগল। স্বপ্নিল বলিউড আর হলিউডের হাজার হাজার অভিনেত্রী সেই টুইটের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে ‘Me To0' লিখে প্রতিবাদ জানাল। অর্থাৎ তারাও তাদের সেই সুখের দুনিয়ায় কোনাে-না-কোনভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার। যেই খ্যাতি আর সুখের জন্য মেয়েগুলাে নিজেদের ডুবিয়ে রেখেছিল পার্থিবতা লাভের মধ্যে, সেই সুখ অর্জন করতে গিয়ে নিজেকে বিকিয়ে বসা সেই অভিনেত্রীরা বুঝেছিল, চোখ ধাঁধানাে এই কর্পোরেট দুনিয়া আসলে আস্ত একখণ্ড নরক।
মিডিয়া আমাদের সামনে যাদেরকে সুখী হিশেবে উপস্থাপন করে, মাঝে মাঝে আমরা তাদের কিছু করুণ পরিণতির গল্প শুনি। লিনকিন পার্কের সেই বিখ্যাত গায়কের কথা মনে আছে? অসম্ভব খ্যাতিতে রাঙানাে ছিল যার ক্যারিয়ার। কী পায়নি লােকটা জীবনে? টাকা, গ্ল্যামার, চাকচিক্যময় জীবন! সবকিছু! তবু কেন তাকে আত্মহত্যা করতে হলাে? এই তাে সেদিন শুনলাম পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কমেডি শাে ‘মিরাক্কেল'-এর সঞ্চালক মীর আত্মহত্যা করতে চেয়েছেন। একবার কিংবা দুবার নয়, এই পর্যন্ত চার-চারবার নাকি আত্মহননের পথে পা বাড়িয়েছিলেন মীর। কী অদ্ভুত, তাই না? বস্তুবাদী দুনিয়া আমাদের যা দিয়ে সুখী করতে চায়, যা লাভে সুখী হতে বলে তার সবটাই তাে এদের আছে। তবু এরা কেন যেন সুখী নয়। এদের জীবনের কোথাও যেন অসুখী হবার ভীষণ অসুখ।

কয়েকদিন আগে বলিউডের এক উঠতি নায়িকার ঘটনায় মুখর ছিল সােশ্যাল মিডিয়া। অভিনয় জীবনের শুরুতেই তাক লাগিয়ে দেওয়া এই নায়িকা জানিয়েছেন তিনি ভালাে নেই। তার খ্যাতি, বিত্ত-বৈভব কিংবা কর্পোরেট মুগ্ধতার কোনাে অভাব নেই। তবু কোথাও যেন তিনি শান্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। সবকিছু থেকেও তার মনে হয় যেন কোথাও আসলে কিছু নেই।

লিনকিন পার্কের সেই গায়ক, মীরাক্কেলের মীর কিংবা নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে খ্যাতি লাভ করা সেই নায়িকা—তারা কি আদৌ সুখী? আদৌ কি তারা তৃপ্ত? সন্তুষ্ট? আদতে সুখের মূল হচ্ছে সন্তুষ্টি। পরিতৃপ্তি। আপনি যখন কোনাে কিছু পেয়ে সন্তুষ্ট হবেন না, তৃপ্ত হবেন না, তখন আপনার মধ্যে একধরনের অস্থিরতা কাজ করবে। যা পেয়েছেন তারচেয়ে বেশি কীভাবে অর্জন করা যায়—সেই নেশা আপনাকে সর্বদা তাড়িয়ে বেড়াবে। আপনি ঘুমের মধ্যেও অস্থির থাকবেন। ঘুম ভাঙলেই আপনার খ্যাতি আর অর্জনের পেছনে দৌড়াতে মন চাইবে। সুখ তাহলে কোথায়?

খালি টাকা আর খ্যাতিই যদি সুখের নিয়ামক হতাে, ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ হতাে পৃথিবীর সেরা পাঁচজন সুখী মানুষের একজন। সবচেয়ে কম বয়সে বিলিওনিয়ার বনে যাওয়া মার্ক জাকারবার্গ কি আসলেই সুখী? তার রয়েছে অসম্ভব রকম খ্যাতি আর বিত্ত। তবে তাতেই যে সে সন্তুষ্ট তা কিন্তু নয়। অন্য আর দশজনের মতাে বেশি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা জেঁকে বসে আছে তার হৃদয়-মনেও। এই আরও অর্জন, আরও পাওয়ার জন্য যা করা দরকার এই ধরনের লােকগুলাে তার সবটাই করতে পারে। জাকারবার্গও করে। এই তাে সেদিন জাকারবার্গকে মার্কিন আদালতের মুখােমুখি হতে হলাে। তার বিরুদ্ধে অভিযােগ উঠেছে সে নাকি আমেরিকার গত নির্বাচনের সময় মার্কিন ইউজারদের তথ্য ফাঁস করেছে কোনাে থার্ড পার্টির কাছে। এই কাজটার জন্য সে নিশ্চয়ই বিশাল অঙ্কের বান্ডেল পেয়েছে। কিন্তু, দিনশেষে কী মিলল ভাগ্যে? ভৎর্সনা! আর মুখােমুখি হতে হচ্ছে বিচারের। এই যে লােভ, এই যে আরও পাওয়া, আরও বড় হওয়ার এক অসুস্থ প্রতিযােগিতা, এটা মানুষকে নৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়। সে যখন লােভ আর লালসার মধ্যে ডুবে যায়, ভালােমন্দের তফাৎ নির্ণয় করা তার পক্ষে আর সহজ হয় না।
কর্পোরেট দুনিয়ার কথিত সুখের পেছনে ছুটতে গিয়ে হতােদ্যম হয়ে যাওয়া মানুষের এ রকম আরও অনেক গল্প আছে। এই গল্পগুলাে থেকে শেখার বিষয় হলাে এই—সুখ আসলে শারীরিক নয়, আত্মিক। আত্মার পরিতৃপ্তিই হলাে সুখের কারণ। আমাদের আত্মা যদি প্রশান্ত না হয়, আমাদের আত্মার যে খােরাক তা যদি আমরা লাভ করতে পারি, তাহলে আমাদের সুখী হওয়াটা একটা নিছক অভিনয় মাত্র। সুখ নয়।

সুখের ব্যাপারে কুরআনের আলাদা ভাষ্য রয়েছে। কুরআন সুখকে অর্থ, বিত্ত কিংবা দুনিয়ার চাকচিক্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করেনি; বরং কুরআন সুখ বলতে বুঝিয়েছে আল্লাহর নিকট নিজেকে একান্ত সঁপে দেওয়াকে। সুখ মানে হলাে অন্তরের প্রশান্তি। অন্তরের স্থিরতা। অন্তর যখন প্রশান্ত, প্রফুল্ল থাকে, তখন একজন মানুষ সুখী হয়। যদি অন্তর বিষাদগ্রস্ত থাকে, অন্তরে যদি ভর করে দুখের কালাে মেঘ, তাহলে একজন মানুষের জীবনটা দুঃখ, কষ্ট আর হতাশায় পর্যবসিত হয়। আরবিতে ‘সাকিনা মানে হলাে অন্তরের প্রশান্তি। কুরআনের যত জায়গায় এই ‘সাকিনা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, সবখানে আমরা ভয়াবহ বিপদ, দুর্যোগ কিংবা দুর্ভোগের ঘনঘটা দেখতে পাই। তবে, সাথে সাথে দেখতে পাই আল্লাহর ওপর ভরসা, তার কাছে নিবেদিত, সমর্পিত কিছু আনুগত্যের নিদর্শন। কুরআন বুঝিয়েছে এটাই সুখ। কুরআনের ভাষায় এটাই অন্তরের প্রশান্তি। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের কাহিনিটার কথাই চিন্তা করা যাক। কী এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিন ছিল সেটা! কুরাইশদের অকথ্য, নির্মম, অবর্ণনীয় নির্যাতন থেকে বাঁচতে মক্কা ছেড়ে তিনি যখন মদিনায় যাচ্ছিলেন, তখন তার সাথি ছিল কেবল আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু। পেছনে তাড়া করছে একদল কুরাইশ বাহিনী। হাঁটতে হাঁটতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু একটা গুহার মধ্যে আশ্রয় নিলেন। ওদিকে, কুরাইশ বাহিনীও একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে। তারা এতটাই নিকটবর্তী হয়ে গিয়েছিল যে, কোনাে কুরাইশ সৈন্য যদি নিজের পায়ের দিকে তাকাত, তাহলেই নবিজি সাল্লয়াললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ধরা পড়ে যেতেন। অবস্থা এমন বেগতিক দেখে ঘাবড়ে গেলেন নবিজির সাথি আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু। তাকে চিন্তিত দেখে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, চিন্তা করাে না। আল্লাহ আমাদের সাথেই আছেন!

শত্ৰু একেবারে নাকের ডগায়। একটু এদিক-সেদিক হলে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা শতভাগ। আর ধরা পড়লেই নিশ্চিত মৃত্যু। এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু যেখানে অস্থির-অশান্ত, সেখানে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরম নির্ভরতায় বললেন, ‘চিন্তা করাে না। আল্লাহ আমাদের সাথেই আছেন! আল্লাহর ওপর এই যে নির্ভরতা, এই যে তাওয়াক্কুল, কুরআন এটাকেই ‘সুখ’, এটাকেই ‘অন্তরের প্রশান্তি হিশেবে উল্লেখ করেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুরআনে বলেছেন-

إذ هما في الغار إذ يقول لصاحبه لا تحزن إن الله معنا فأنزل الله كيئته عليه যখন তারা উভয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় অবস্থান করছিল, সে তার সঙ্গীকে বলল, তুমি চিন্তা করাে না। আল্লাহ আমাদের সাথেই আছেন! অতঃপর আল্লাহ তার অন্তরে প্রশান্তি দান করলেন।[1]

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর ওপর ভরসা করেছেন, আর আল্লাহ তার হৃদয়ে ঢেলে দিয়েছেন প্রশান্তির ফল্গধারা। সেই প্রশান্তির সামনে দুনিয়ার যেকোনাে বিপদ নস্যি, তুচ্ছ। জীবনের এই যে দুঃসময়, দুর্যোগ আর দুর্ভোগের মুহূর্ত, এই মুহূর্তগুলােতে আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার মাঝেই রয়েছে পরিপূর্ণ তৃপ্তি। সুখ। প্রশান্তি। আজকাল মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি ছেড়ে এমন সব বিষয়ে সুখের সন্ধানে ব্যস্ত, যেখানে আদতে মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই নেই।
সুখ কীসে—এই প্রশ্নটা মানব-ইতিহাসের আদিমতম প্রশ্নগুলাের একটা। মানুষ তার অস্তিত্বের শুরু থেকেই এই প্রশ্নের পেছনে ছুটে চলেছে নিরন্তর। বহু বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজবিদ এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং করছেন। কিন্তু, সবাই ঘুরে ফিরে আমাদের সেই বস্তুবাদী দুনিয়ার দিকেই ডেকে চলেন নিরন্তর। বস্তুবাদী দুনিয়াই যদি সুখের আঁকড়া হবে, কেন আমরা সেই দুনিয়ার করুণ আর্তচিৎকার শুনি প্রতিনিয়ত? কেন সেই দুনিয়া থেকে চাপা কান্নার স্বর আমাদের কানে এসে বাজে? কেন সেই দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষগুলাে বেছে নেয় আত্মহননের পথ?

আগেই বলেছি, বস্তুবাদী দুনিয়ার চোখ ধাঁধানাে এসব আয়ােজনে সুখ নেই। এগুলাে নিজের আত্মার সাথে প্রবঞ্চনা বৈ কিছু না। সুখের নাম করে নেহাত মরীচিকার পেছনে দৌড়ানাে। সুখ আসলে কোথায়—এই প্রশ্নের সবচেয়ে স্পষ্ট, সবচেয়ে যৌক্তিক উত্তরটা এসেছে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন—

মানুষের শরীরে এমন একটি মাংসপিণ্ড আছে যেটা সুস্থ থাকলে মানুষের সারা শরীর সুস্থ থাকে। আবার যেটা অসুস্থ হলে মানুষের সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর তা হলাে অন্তর। [1]

কোন সেই মাংসপিণ্ড? সেটা হলাে অন্তর। অন্তর যদি সুস্থ থাকে, সতেজ থাকে, তাতে যদি ভর না করে কোনাে আত্মপ্রবঞ্চনা, তাহলে সেই মানুষটা সুখী। আবার যার হৃদয় আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত, সে যতই সুখী হওয়ার ভান করুক, সেটা দিনশেষে স্রেফ অভিনয়।

বিখ্যাত “Yes! Magazine একবার সুখী হওয়ার কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় নিয়ে ফিচার করেছিল। সুখী হওয়ার জন্য তারা যে কয়েকটা উল্লেখযােগ্য কারণ চিহ্নিত করেছিল তার মধ্যে একটা হলাে—তুলনা এড়িয়ে চলা। অর্থাৎ একজন দিনদিন ধনী থেকে ধনী হচ্ছে বলেই যে আমাকেও ধনী হতে হবে, এ রকম মানসিকতা এড়িয়ে চলা। বরঞ্চ নিজেকে নিয়ে, নিজের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। কুরআনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে, আমাদের রব ঠিক সেই পথই বাতলে দিয়েছেন যা আজকের দার্শনিকেরা সুখী হওয়ার জন্য নিয়ামক বানাচ্ছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন—

ولا من عينيك إلى ما معنا به أزواجا منهم زهرة الحياة الدنيا لنفتنهم فيه ورزق ربك خير وأن

কখনােই সে-সমস্ত বস্তুর দিকে তাকাবেন না, যা আমি তাদের (দুনিয়াপূজারীদের) উপভােগের জন্য দিয়েছি। এসব দিয়ে আমি তাদের পরীক্ষা করি। বস্তুত, আপনার প্রতিপালকের দেওয়া রিযিকই হলাে সবচেয়ে উত্তম ও সবচেয়ে বেশি স্থায়ী [1]

আজকের দুনিয়ায় অসুখী হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত এই দুনিয়াপূজাই। মানুষ সম্পদের মােহে বিভাের। তার প্রতিবেশী দিনের পর দিন সম্পদের পাহাড় বানাচ্ছে বলে তাকেও যেভাবে তােক সম্পদশালী হতে হবে। তার কলিগের টয়ােটা ব্র্যান্ডের গাড়ি আছে বলে তারও একটা টয়ােটা ব্রান্ডের গাড়ি থাকতে হবে। তার বন্ধু Iphone 11 চালায় বলে তাকেও Iphone 11 ব্যবহার করতে হবে। এই যে অসুস্থ প্রতিযােগিতা, এই প্রতিযােগিতা মানুষকে আল্লাহর রাস্তা থেকে বিচ্যুত করে দেয়। আমরা ছিটকে পড়ি সত্যিকার সুখের রাস্তা থেকে, যে রাস্তায় আমাদের দেহ-মন প্রশান্তি লাভ করে। এজন্যেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের তুলনা এড়িয়ে চলতে বলেছেন। যারা দুনিয়াপূজায় মত্ত হয়ে আছে, তাদের দিকে ফিরে তাকাতে নিষেধ করেছেন এবং এও বলেছেন, কেবল তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা রিযিক হিশেবে আমাদের দান করেছেন।

সুখী হবার জন্য Yes! Magazine-এর পরের উপায় হলাে— Smile, even when you don't feel like it.' অর্থাৎ হাসুন, এমনকি যখন দুঃখ ভর করে মনে, তখনাে। যারা হাসতে পারে, তাদের প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষ হিশেবে দেখা হয়। তাদের মনের মধ্যে সবসময় একটা আশার আলাে জ্বলজ্বল করে। 
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

কোনাে ভালাে কাজকেই ছােট মনে করাে না, এমনকি যদি সেটা তােমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলাও হয়।

জারির ইবনু আব্দিল্লাহ আল-বাজালি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, যেদিন থেকে আমি ইসলামে দাখিল হই, সেদিন থেকে এমন কোনােদিন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়নি যখন তার মুখে হাসি ছিল না! [3]

হকোণে যদি আশা না থাকে, যদি মানুষের পরম একটা ভরসার স্থল, নির্ভরতার কেন্দ্র না থাকে, তাহলে সে মানুষ প্রচণ্ড হতাশায় ডুবে যাবে। আমরা যদি জীবনের প্রতিকূলতার কথা চিন্তা করি, তাহলে নবিজির জীবনই আমাদের সামনে সবচাইতে বড় উদাহরুণ। মানবজীবনে এমন কোনাে বিপদ নেই, এমন কোনাে দুর্যোগ নেই যা নবিজি সালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে নেমে আসেনি। তদুপরি তিনি সর্বদা আশাবাদী মানুষ ছিলেন। তিনি কখনােই হতাশ হননি। তার জীবন ছিল হাসিখুশি, কর্মচঞ্চল।

Yes! Magazine-এর সেই ফিচারে সুখী হবার উপায় হিশেবে আরও বলা ছিল- কৃতজ্ঞ হওয়া, দান করা, এমনকি টাকার পেছনে হন্যে হয়ে না ছোেটাকেও তারা সুখী হওয়ার নিয়ামক হিশেবে উল্লেখ করেছিল। তারা বলেছিল, ‘Put money low on your list of properties ।'

ইসলামে কৃতজ্ঞ হওয়ার ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। একজন মুমিনের পুরাে জীবনটাই কৃতজ্ঞতার বাঁধনে বাঁধা। সে হাঁচি দিলে বলে—আল-হামদু লিল্লাহ' অর্থাৎ ‘সমত প্রশংসা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার। আবার যখন সে জীবনে কোনাে কিছু অর্জন করে, তখনাে বলে ‘আল-হামদু লিল্লাহ। যেকোনাে মুহূর্তে, যেকোনো পরিস্থিতিতে, হােক সুখের কিবা দুখের—একজন মুমিন সর্বদা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। এজন্যই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, ‘মুমিনের ব্যাপারটাই আশ্চর্যের। তার সকল বিষয়ই কল্যাণকর! সে যখন সুখে থাকে, তখন সে তার রবের প্রতি কৃতজ্ঞ হয় এবং এটা তার জন্য উত্তম। আবার, সে যখন কঠিন দুখকষ্টের ভেতর দিয়ে যায়, তখন সে সবর করে এবং রবের কৃতজ্ঞতা জানায়। এটাও তার জন্য উত্তম। [1]

মুমিনের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র তার রবের কৃতজ্ঞতায় ভরা। আখিরাতের অনন্ত জীবনের সুখের জন্য দুনিয়ার জীবনে মহান আল্লাহ তাআলার আনুগত্য, তার সন্তুষ্টি এবং সন্তোষের পথে হাঁটতে পারাটাই সত্যিকারের সুখ। হ্যামিলনের বংশীবাদকেরা আমাদের যে অদ্ভুত সুরে সুখের পথে ডাকে, সেই পথে আছে কেবল ধোঁকা আর প্রতারণা। কর্পোরেট দুনিয়ার রঙিন চশমা পরে চোখের সামনে দিয়ে তরতর করে আকাশ ছুঁতে থাকা ইট-পাথরের কোঠরে সুখ নেই। সুখ নেই বস্তুবাদী মহলের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত ‘বড় হওয়া’ আর ‘নাম কুড়ানাের মাঝে। এসব নিছকই চোরাবালি। খাদের কিনারায় পা ফসকালে যেমন তলিয়ে যেতে হয় অতল গহ্বরে, এই দুনিয়া ঠিক তেমনই। পা ফসকালেই বিপদ। কুরআনের ভাষায়—

وما الحياة الدنيا إلا لعب ولهو

এই দুনিয়ার জীবন নিছক খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।[2]

আপনার রব জানাচ্ছেন এই দুনিয়া হলাে নিছক খেল-তামাশার ক্ষেত্র। একটা ধোঁয়াশা। একটা কূপ। একটা ফাঁদ। এখানে যা সুখ বলে ধরা হয় তা আসলে মরীচিকা। সুখ তাে নিহিত আছে স্রষ্টার আনুগত্যে। এই কঠিন এবং অপ্রিয় সত্য যারা বুঝেছে, তারাই পেয়েছে সত্যিকার সুখের সন্ধান। সুখ তাে কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে। সুখ আছে আনুগত্যে মাথা নােয়ানােতে। সুখ আছে বান্দার নিরীহ আকুল ফরিয়াদে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ